বায়ুমণ্ডলের চাপ কেমন করে পরিমাপ করা হয়?




 বায়ুর এক পুরু কম্বল দিয়ে আমাদের পৃথিবীটা ঢাকা। বায়ুর এই পুরু আস্তরণকে বলে বায়ুমণ্ডল। বাতাসের ওজন আছে বলে সে চাপ প্রয়োগ করে থাকে। বায়ুমণ্ডলের চাপ পরিমাপের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহৃত হয় তাকে ব্যারোমিটার (Barometer) বলে। বায়ুমণ্ডলের চাপের পরিবর্তন

আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, সমুদ্র সমতল থেকে কোনো বস্তুর উচ্চতা পরিমাপের জন্যও বায়ুমণ্ডলের চাপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বায়ু যে চাপ প্রয়োগ করে তা ১৯৪৩ সালে ইতালির ইভানজেলিস্টা টরিসিলি' (Evangelista Toricelli) নামক এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম পরীক্ষা সহকারে প্রদর্শন করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, সমুদ্র সমতলে বায়ুমণ্ডলের চাপ সাধারণ পারদ স্তম্ভের ৭৬ সেন্টিমিটার। বায়ুমণ্ডলের চাপ নির্ণয়ের জন্য তিনি একটি সরল পারদ ব্যারোমিটার তৈরি করেন।

 নীহারিকা কী? 

দূরবীণের মধ্য দিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকালে আমরা বড় বড় অনেক সাদা-কালোর দাগ বা ফোঁটা ফোঁটা চিহ্ন দেখতে পাই। ঐসব চিহ্নগুলোই হলো নীহারিকা (Nabulae)। নীহারিকার ইংরেজি শব্দ হলো নেবুলা (Nebula)। ‘নেবুলা' কথাটি আবার ল্যাটিন ভাষা থেকে সংগৃহিত- যার অর্থ হলো কুয়াশা (Mist)। প্রকৃতপক্ষে নীহারিকা আমাদের কাছে কুয়াশার মতোই মনে হয়। কালো কালো চিহ্ন বা দাগগুলোকে বলা হয় ‘কৃষ্ণ নীহারিকা' (Black Nebulae) আর সাদাগুলোকে বলা হয় 'দীপ্ত নীহারিকা' (Bright Nebulae) প্রকৃতপক্ষে এই সব নীহারিকাপুঞ্জে থাকে গ্যাসীয় পদার্থ, ধূলিকণা আর ঝাঁক ঝাঁক তারকা (Cluster of Stars)। এই সব নীহারিকাপুঞ্জের অনেকগুলোই আমাদের ছায়াপথে (Milky Way-আকাশগঙ্গা) অবস্থিত। তবে আরও বেশি সংখ্যক নীহারিকা আছে ছায়াপথের বাইরে। শক্তিশালী দূরবীণের সাহায্যে এদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগৃহিত হয়েছে। আমাদের ছায়াপথে প্রায় ২০০০টি নীহারিকা আছে। ধারণা করা হয়। যে, লক্ষ লক্ষ নীহারিকা আছে ছায়াপথের বাইরে। এদের কারও আকার

উপবৃত্তের ((Elliptical) মতো, কেউ বা কুণ্ডলাকৃতির (Spiral), আবার কারও বা নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। নীহারিকার তাপমাত্রা ৬০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে ১২০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। দীপ্ত নীহারিকা থেকে কৃষ্ণ নীহারিকার তাপমাত্রা অনেক কম। আর এই জন্যই ওদের কালো দেখায়। নীহারিকায় প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস থাকে। বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু নীহারিকার ছবি তুলেছেন। কর্কট নীহারিকার (Crab Nebula) ছবি থেকে জানা গেছে যে, নীহারিকাটির দূরত্ব পৃথিবী থেকে ৬০০০ আলোকবর্ষ। একটা নীহারিকার ছবি দেখতে ঘোড়ার মাথার মতো। সেই জন্য ঐ নীহারিকাটির নাম 'হর্স নেবুলা' (Horse Nebula)। আর একটিকে দেখতে বলয় বা আংটির মতো। তাই তার নাম রাখা হয়েছে। 'রিং নেবুলা' ((Ring Nebula)। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে অনেকগুলো নীহারিকা পর্যবেক্ষণ করেছেন। তারকারা মিট মিট করে কেন? রাতের বেলায় আকাশে আমরা লক্ষ লক্ষ তারাকে মিট মিট করতে দেখি। - তাদের আলো তারা চতুর্দিকে বিকিরণ করে চলে। দেখতে ওরা ছোট হলেও প্রকৃতপক্ষে ওরা প্রকাণ্ড। বেশিরভাগ তারকারাই আমাদের পৃথিবীর চেয়ে বহুগুণ বড়। পৃথিবী থেকে ওদের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ার ফলেই ওদেরকে অত ছোট দেখায়। আমাদের পৃথিবীটা বাতাসের এক পুরু আস্তরণ দিয়ে ঢাকা। বাতাসের এই পুরু আস্তরণকে আমরা বায়ুমণ্ডল (Atmosphere) বলি। বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত সকল গ্যাসীয় পদার্থ সর্বদাই গতিশীল। গ্যাসীয় পদার্থের চলাচলের ফলে বায়ুমণ্ডলের সকল জায়গায় বায়ুর ঘনত্ব একরকম হয় না। তার ফলে বাতাসের প্রতিসরাঙ্ক (Refractive Index) স্থান ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। কোনো তারকা থেকে আগত আলোকরশ্মি যখন আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন আমাদের চোখে সে পৌছানোর আগে বায়ুস্তরের ঘনত্ব তথা প্রতিসরাঙ্কে পরিবর্তন হেতু বহুবার সেই আলোকরশ্মির দিক বিচ্যুতি (Deviation) ঘটে। এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় আলোর চলার পথ পরিবর্তন করাকে প্রতিসরণ (Refraction) বলে। উক্ত প্রতিসরণের জন্য কোনো তারকা থেকে যে আলো চোখে এসে পড়ে তার পরিমাণ কম-বেশি হতে থাকে। আলোর এই পরিবর্তনের জন্যই তারকাদের মিট মিট করে জ্বলতে দেখা যায় । ১৯ চাঁদ, সূর্য কিংবা গ্রহগুলো তারকাদের তুলনায় পৃথিবীর খুবই নিকটবর্তী। তার জন্য ওদেরকে তারকাদের তুলনায় বড় বলে মনে হয়। তারকারা আমাদের চোখে যে কোণ (Angle) উৎপন্ন করে চাঁদ, সূর্য ও গ্রহেরা করে তার থেকে অনেক বড় কোণ। কোণ বড় হওয়ার দরুণ চাদ. সূর্য ও গ্রহ থেকে আসা আলোর পথ-বিচ্যুতি আমাদের চোখ বুঝতে পারে না। এই জন্য চাঁদ, সূর্য ও গ্রহদের মিট মিট করতে দেখা যায় না। 

দিনের বেলায় আমরা তারকাদের দেখতে পাই না কেন? 

সূর্যাস্তের পর পরই আকাশে তারার ফুল ফুটে উঠতে শুরু করে। তারপর রাত যতই গভীর হয়, আকাশে তারার সংখ্যা ও তাদের ঔজ্জ্বল্যও ততই বাড়তে থাকে। শেষ রাতের দিকে ভোরবেলাটি যত এগিয়ে আসতে থাকে, দৃশ্যমান তারকার সংখ্যা ততই হ্রাস পেতে থাকে। কেবলমাত্র বেশি ঔজ্জ্বল্যের তারকাগুলোই তখন দৃষ্টিগোচর হয়। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তারকারা সবাই আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। তোমরা কী জান— কেন দিনের বেলায় তারকাদের দেখা যায় না? কেউ কেউ মনে করে রাতের বেলায় যেমন সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমনি দিনের বেলায় তারকারাও অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্য নয়। তারকার। কখনও অদৃশ্য হয়ে যায় না। দিনের বেলায় সূর্যের প্রচণ্ড উজ্জ্বলতায় কেবল তারা দৃষ্টিগোচর হতে পারে না । প্রকৃতপক্ষে বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণা গ্যাসীয় পদার্থ ও জলীয়বাষ্প সূর্যের আলোক-রশ্মিকে চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত (Scatter) করে দেয়। এই জন্যই সমগ্র বায়ুমণ্ডলটিকে বেশ উজ্জ্বল দেখায়। সূর্যের আলোর তুলনায় দূরের ঐ তারকার আলো অত্যন্ত ক্ষীণ। দিনের বেলায় ঐ ক্ষীণ আলো আমাদের চোখে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তাই দিনের বেলায় আমরা তারকাও দেখতে পাই না । প্রজ্জ্বলিত কোনো বাতিকে পর্যবেক্ষণ করলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। রাতের বেলায় বাতির আলো অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। তবে দিনের বেলায়। অতি ক্ষীণ আলোও আমাদের চোখে এসে ধরা পড়তে পারে। এই জন্যই ক্ষীণ আলোর তারকারা দিনের বেলায় আমাদের চোখে অদৃশ্য হয়ে ওঠে। সামান্য দূর থেকেও তা গোচরীভূত হয় না। তেমনি করে রাতের বেলায় পৃথিবীর যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত, তাহলে দিনের বেলায়ও আমরা তারকাদের দেখতে পেতাম ।

পৃথিবী থেকে নক্ষত্রের দূরত্ব কেমন করে মাপা হয়? 


রাতের বেলায় যেসব তারকাদের জ্বল জ্বল করতে দেখি, তারা দেখতে খুব মনোরম ও উজ্জ্বল। কতকগুলো তারকাকে অন্যদের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল দেখায়। তারকাদের আকার ও পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলেই ঐ রকম হয়। এই সব তারকারা আমাদের পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থিত, আর নিজস্ব আলোকেই তারা ভাস্বর। তোমরা কী জানো—পৃথিবী থেকে ঐ সব তারকাদের দূরত্ব কেমন করে মাপা হয়? নিকটস্থ নক্ষত্রের দূরত্ব মাপবার এক সহজ উপায় বিজ্ঞানীরা বের করেছেন। ধরা যাক, কোনো একটি নির্দিষ্ট তারকা 'C'-র দূরত্ব আমরা মাপতে চাই। পৃথিবীর 'A' অবস্থান থেকে তারকাটির একটি আলোকচিত্র (Photograph) গ্রহণ করি। এর ছয় মাস পর পৃথিবী ‘B’ অবস্থানে পৌছাবে। কারণ পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে এক বছরে একবার ঘুরে আসে । এবার পৃথিবী 'B' অবস্থান থেকে ঐ তারকাটির আর একটি আলোকচিত্র গ্রহণ করি। আলোকচিত্র দুইটির তুলনা করলে দেখা যাবে যে, পৃথিবীর আবর্তন হেতু তারকাটির অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে। এর থেকে ACB কোণটির পরিমাপ করা হয়। আমরা জানি, এখানে AB হলো পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস। এর মান হলো ১৮৬ মিলিয়ন (১৮ কোটি ৬০ লক্ষ) মাইল। উক্ত কোণ ও পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাসের মান থেকে 'C' তারকার দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। উপরোক্ত উপায়টির অবলম্বনে অনেক তারকার দূরত্ব নির্ণীত হয়েছে। পৃথিবী থেকে ‘আলফা সেঞ্চুরি (Alpha Century) নক্ষত্রের দূরত্ব পাওয়া গেছে প্রায় ৪.৩৫ আলোক-বর্ষ 'সিরিয়াস' (Sirius) নক্ষত্রটির ভিত্তি করে। পৃথিবী থেকে ৮ মিলিয়ন (৮০ লক্ষ) আলোক-বর্ষ দূরে অবস্থিত তারকাদের দূরত্ব মাপতেও বিজ্ঞানীরা আজ সফল হয়েছেন।

 মহাদেশগুলো সৃষ্টি কেমন করে হয়েছিল?

 বিপুল পানিভাগ আর বিশাল স্থলভাগে আমাদের পৃথিবীটা বিভক্ত। বিপুল পানিরাশিকে আমরা বলি মহাসমূদ্র। তেমনি বিশাল স্থলভাগকে বলি মহাদেশ। পৃথিবীতে ৭টি মহাদেশ আছে। তাদের নাম ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আন্টাষ্টিকা । তোমরা কী জানো—কেমন করে এই মহাদেশগুলোর সৃষ্টি হয়েছে? মহাদেশগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে 'আলফ্রেড ওয়েগেনার' (Alfred Wegener) ১৯১২ সালে সর্বপ্রথম একটি মতবাদ প্রদান করেন। উক্ত

মতবাদের নাম 'মহাদেশীয় সরণ' (Continental Drift)। এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, কোনো এক সময় সাতটি মহাদেশ একত্রিত থেকে তৈরি করেছিল এক 'অতিকায় মহাদেশ' (Super Continent)। প্রায় ২৫০ মিলিয়ন (২৫ কোটি) বছর আগে (অঙ্গার-উৎপাদী কালের শেষদিকে Late Carboniferous Period) মাত্র একখণ্ড বিশাল স্থলভাগের উৎপত্তি। ঘটেছিল। ঐ স্থলভাগের নাম ছিল 'প্যাঙ্গাইয়া' (Pangaea)। এর প্রায় ৬৫ মিলিয়ন (৬ কোটি ৫০ লক্ষ) বছর পরে বিশাল ঐ ভূখণ্ডটি বৃহৎ বৃহৎ দুইটি ভূখণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। ভূ-খণ্ড দুইটির নাম হলো—লউরাসিয়া (Laurasia) ও গোল্ড-ওয়ানাল্যান্ড (Gondwanaland)। তারপর বৃহৎ ঐ ভূ-খণ্ড দুইটি একে অপর থেকে দূরে হটে চলতে থাকে। লাউরাসিয়া ভূখণ্ড থেকে উৎপত্তি হয় উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং আন্টাক্টিকা মহাদেশগুলো। মহাদেশগুলো একত্রিত হয়ে যে বিশাল ভূখণ্ড তৈরি করে— তা উপরোক্ত মতবাদকে সমর্থন করে। মহাসমুদ্র-গবেষণা (Ocean Reseaches) থেকে উক্ত ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। মহাদেশীয় (Paleontolgist জীবাশ্ববিদ) আন্টাক্টিকা মহাদেশে খুঁজে পেয়েছেন বিলুপ্ত উদ্ভিদ ও সরীসৃপের ফসিল বা জীবাশ্ম। ঐ জীবাশ্ম বিজ্ঞানীদের মনে এই বিশ্বাস জন্মিয়েছে যে, আজকের অবস্থানে আসবার আগে দক্ষিণ মেরুর তুষারাবৃত আন্টাক্টিকা মহাদেশটি ছিল একটি উষ্ণ মহাদেশ। আধুনিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, মহাদেশগুলো এখনও একে অপর থেকে দূরে সরে চলেছে।

Leave a Comment