মহাকাশ কাহাকে বলে?

    


    আমরা জানি যে, আমাদের পৃথিবীর সকল দিকেই বায়ুমণ্ডল নামে পরিচিত বায়ুর ঢাকনায় ঢাকা আছে। আমরা যতই উপরে ভাঠ বায়ু ততই পাতলা হতে থাকে এবং এইভাবে এটা এত পাতলা হয়ে যায় যে, সচল বস্তুর উপর কোনো সংঘর্ষ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা থাকে না। এই উচ্চতাকে আমরা বলি বায়ুমণ্ডলের সীমারেখা। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে যে বিরাট এলাকা তাকে বলা হয় স্পেস (Space) বা মহাকাশ।



 পৃথিবীর ভূমিতল থেকে ১০০ কি.মি.-এর চাইতেও বেশি দূরবর্তী এলাকাকে বৈজ্ঞানিকরা স্পেস বা মহাকাশ বলে বর্ণনা করেন । স্পেস বা মহাকাশকে অন্তহীন বিস্তীর্ণ শূন্যস্থান বলে বর্ণনা করা হয়, যার মনুষ্য জ্ঞানানুযায়ী কোনো সীমানা নাই। আপাতদৃষ্টিতে এটা অন্তহীনভাবে সকল দিকে বিস্তৃত এবং তার মধ্যবর্তী সকল শূন্যস্থান। আমরা মহাকাশযানে যেখানেই যাই না কেন অথবা দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যাই দেখি না কেন আমরা কখনও মহাকাশের সীমানা অতিক্রম করতে পারব না। নক্ষত্রবিদরা নিকটবর্তী গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যাকর্ষণজনিত প্রভাব অনুসারে প্রায়শই মহাকাশের অঞ্চলগুলোর নাম নির্দেশ করেন। উদাহরণস্বরূপ, গ্রহসমূহের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলা হয় ইন্টারপ্ল্যানেটারী স্পেস (interplanetary space) অর্থাৎ গ্রহসমূহের মধ্যবর্তী মহাকাশ। সূর্যের মধ্যাকর্ষণ যতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত আছে তার সম্পূর্ণ এলাকাই গ্রহসমূহের মধ্যবর্তী মহাকাশের অন্তর্ভুক্ত। গ্রহসমূহের মধ্যবর্তী মহাকাশ প্লুটো (Pluto)-কে ছাড়িয়ে বহু বিলিয়ন (billion) কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন নক্ষত্রে মধ্যবর্তী স্থানকে বলা হয় ইন্টারস্টেলার স্পেস (interstellar space) অর্থাৎ নক্ষত্রসমূহের মধ্যবর্তী মহাকাশ। সূর্য থেকে তার নিকটতম নক্ষত্র, প্রক্সিমা সেন্টরি (proxima Centauri)-র দূরত্ব প্রায় ৪.৩ লাইট ইয়ার (light years)। এইভাবে অন্যান্য নক্ষত্রগুলোর মধ্যবর্তী অঞ্চলকেও ইন্টারস্টেলার স্পেস বলা হয়। গ্যালাক্সি (Galaxy) বা ছায়াপথগুলোর মধ্যবর্তী অঞ্চলকে বলা হয় ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেস (intergalactic space)। এই অঞ্চল সকল দিকেই এত বেশিদূর পর্যন্ত বিস্তৃত যে তা কল্পনাতীত- সম্ভবত অন্তহীনতা পর্যন্ত। এইভাবে এই সীমাহীন আকাশই হলো স্পেস বা মহাকাশ । যদিও আমরা মহাকাশকে একটি শূন্যস্থান বলে মনে করি, কিন্তু তথাপি ভাতে রয়েছে নক্ষত্র বালুকা এবং উল্কার কণিকা। মহাকাশের মধ্যে কসমিক রে পারটিকস (cosmic ray particles) অর্থাৎ মহাকাশ রশ্মির কণিকা এবং এক্স-রে (X-ray) অর্থাৎ রঞ্জনরশ্মি রয়েছে। সামান্য পরিমাণে কিছু গ্যাসও সেখানে থাকতে পারে। বর্তমানে বৈজ্ঞানিকরা মহাকাশ সম্পর্কে আরও অধিকতর জ্ঞান অর্জনের জন্য তাদের ক্ষমতানুযায়ী চেষ্টা করছেন। দূরবর্তী দিগন্তে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তারা রকেট, স্যাটেলাইট, মহাকাশযান এবং মহাকাশ পরীক্ষা যন্ত্র পাঠাচ্ছেন। মানুষ ইতিমধ্যেই চন্দ্রের ভূপৃষ্ঠে পদার্পণ করেছে এবং অন্যান্য গ্রহ ও তাদের উপগ্রহ সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এটা অবশ্যই সম্ভব যে, অদূর ভবিষ্যতে মানুষ মহাকাশ সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

গ্রহানুপুঞ্জ কী? 

আমরা সবাই জানি যে, আমাদের সৌরজগতে ৮টি গ্রহ আছে যারা সবাই উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারদিকে সর্বদা প্রদক্ষিণ করে চলে। ওই ৮টি গ্রহ ছাড়াও ছোট ছোট আরও অনেক বস্তুপিণ্ডগুলোকে গ্রহাণু বা ক্ষুদে গ্রহ বলে (Asteroids or planetorids) | 

 


আজ পর্যন্ত প্রায় ১৬০০টি গ্রহাণু আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্যেকটি গ্রহাণুর আপন কক্ষপথ রয়েছে। ঐ পথেই সে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। সব থেকে বড় গ্রহাণুর নাম সিরেজ (Ceres)। এর আকার পৃথিবীর আকারের ১/৮০০ গুণ। ইতালির জ্যোতির্বিদ “পিয়াজী' (Piazzi) ১৮০১ সালের জানুয়ারিতে ওই গ্রহাণুটি আবিষ্কার করেন। গ্রহাণুদের ব্যাস ১৪ কিলোমিটার থেকে ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। গ্রহাণুপুঞ্জের সকল গ্রহাণুর মিলিত ভর পৃথিবীর ভরের ১/৩০০০ গুণ। গ্রহাণুপুঞ্জের দুই-তৃতীয়াংশ গ্রহাণুর কক্ষপথ মঙ্গল ((Mars) ও বৃহস্পতি (Jupiter) গ্রহের কক্ষপথের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। কিছু কিছু গ্রহাণু বুধ (Mercury) ও মঙ্গলের মধবর্তী স্থানে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। ইনকারাস (Incarus) নামের গ্রহাণুটি ঐ রকম একটি গ্রহাণু 'হিডালগো' (Hidalgo) নামের গ্রহাণুটির কক্ষপথ মঙ্গল ও শনি (Saturn) গ্রহের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। 'হারমেস' ও 'ইরমেস' (Hermes and Eros) নামক গ্রহাণুর অবস্থান পৃথিবী থেকে কয়েক লাখ কিলোমিটারের মধ্যে। শক্তিশালী দূরবীণ দিয়ে এই বস্তুপিণ্ডগুলোকে চাকির (Saucer) মতো দেখতে লাগে। এদের কেউ কেউ খুব উজ্জ্বল। আবার কেউ কেউ বেশ নিষ্প্রভ। ওদের আকার (Size) দিয়েই অধিকাংশ গ্রহাণু তৈরি। তবে তাদের পৃষ্ঠ তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। গ্রহাণুপুঞ্জের উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, শূন্যের বুকে কোনো বৃহৎ গ্রহের বিস্ফোরণ হয়ত কখনও হয়েছিল, যার ফলে গ্রহটি ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হয়। তারপর গ্রহাণুরূপে সূর্যকে তারা প্রদক্ষিণ করা শুরু করে। তবে গ্রহাণুপুঞ্জের সৃষ্টি সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। আশা করা যাচ্ছে, ১৯৯০ সাল নাগাদ আকাশের এই সব বস্তুপিণ্ড সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যাবে। কারণ, বিজ্ঞানীরা নভোমণ্ডলস্থ এই সব বস্তুপিণ্ডের দিকে মহাকাশযান পাঠানোর অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

 নক্ষত্রপুঞ্জ কী?

 এক দলে অনেকগুলো নক্ষত্রের সমাবেশকে নক্ষত্রপুঞ্জ (constellation) বলে।



 প্রাচীনকালে মানুষ যখন নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে তখন সে এমনি অনেক নক্ষত্রপুঞ্জ আকাশে লক্ষ্য করেছিল। সে আরও লক্ষ্য করেছিল যে, এক একটি নক্ষত্রপুঞ্জের বিভিন্ন নক্ষত্রকে যদি কাল্পনিক রেখা দিয়ে সংযুক্ত করা যায় তাহলে তার পরিচিত কোনো চিত্র বা আকৃতিতে রূপ  নেয়। এইরূপ তারকার দলকে নক্ষত্রপুঞ্জ বলা হয়। নক্ষত্রপুঞ্জের নামকরণ ও পর্যবেক্ষণ শেষ হয়েছে। এ যাবৎ ১০টি কিছু নক্ষত্রপুঞ্জ আছে যাদেরকে শুধু উত্তর গোলার্ধ থেকেই দেখা যায়। তেমনি আবার কিছু আছে যারা শুধু দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। উপরের ছবিতে উত্তর গোলার্ধ থেকে গ্রীষ্ম ও শীতকালে দৃশ্যমান কিছু নক্ষত্রপুঞ্জকে দেখানো হয়েছে। সিংহ (Leo-Lion), বৃষ (Taurus-Bull) বড় ভাল্লুক (Ursa Major- Great Bear, এটাই সপ্তর্ষিমণ্ডল), কালপুরুষ (orion Hunter), মরাল (Cygnus-Swan) প্রভৃতি হলো কয়েকটি সুপরিচিত নক্ষত্রপুঞ্জ। সব কয়টি নক্ষত্রপুঞ্জে চিত্রলিপি (Chart) পাওয়া যায়। ঐ চিত্রলিপির সাহায্যে আকাশে ওদেরকে সহজে চিনে নেওয়া যেতে পারে। ওদের কাউকে শীতকালে আবার কাউকে বা গ্রীষ্মকালে দেখা যায়। অতীতে মানুষ সমুদ্রযাত্রায় গিয়ে এই সব নক্ষত্রপুঞ্জের সাহায্যে দিক নির্ণয় করতেন। তবে পৃথিবীর সাপেক্ষে এদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। একমাত্র ধ্রুবতারার (North Star or Polaris) অবস্থানই পরিবর্তিত হয় না।। একবার ধ্রুবতারাকে চিনে নিতে পারলে অন্যান্য অনেক নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান উক্ত চিত্রলিপির সাহায্যে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ঐসব নক্ষত্রপুঞ্জ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । ওরা আকাশের অন্যান্য তারকার অবস্থান নির্ণয় করতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অক্ষাংশ (Latitude) ও দ্রাঘিমাংশ (Longitude) যেমন ভূ-পৃষ্ঠস্থ শহর, বন্দর পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্র প্রভৃতির অবস্থান নির্ণয়ে দরকারি, ঠিক তেমনি আকাশের বিভিন্ন তারকার পর্যবেক্ষণেও (Astronauts) মহাশূন্য নক্ষত্রপুঞ্জগুলো দরকারি নভোচারীদের পরিভ্রমণকালে নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর বিশেষ প্রয়োজনীয়তা প্রমাণিত হয়েছে। আলোকবর্ষ কী? ছোট ছোট দূরত্ব—যেমন বই অথবা ফাইলের দৈর্ঘ্য কিংবা প্রস্থ পরিমাপ করা হয় সেন্টিমিটার অথবা ইঞ্চিতে। এর থেকে বড় দূরত্ব মাপা হয় মিটার বা ফুটে (Feet)। তার থেকেও বড় দূরত্ব মাপা হয়ে থাকে কিলোমিটার কিংবা মাইলে। কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন অথবা ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্ব উপরোক্ত ছোট এককে প্রকাশ (Unit) করা যায় না। তার জন্য আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক এককের দরকার পড়ে। আলোকবর্ষ হলো, প্রকৃতপক্ষে, ঐ দূরত্বেরই একক-যা পৃথিবী ও অন্যান্য নক্ষত্রের মধ্যকার বিরাট দূরত্ব নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক বছর সময়ে আলো যতটা পথ বা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তাকেই বলে এক আলোকবর্ষ (Light Year)। আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে কিলোমিটার কিলোমিটার এই বেগে চলে আলো ১ মিনিটে দূরত্ব অতিক্রম করে। এক মিনিটের ১,৮০,০০,০০০ অতিক্রান্ত এই দূরত্বকে বলে “আলোক মিনিট” (Light minute)। যখন আমরা বলি যে,— নভোমণ্ডলস্থ বস্তুপিণ্ড এক “আলোক মিনিট” দূরে অবস্থিত, তখন তার অর্থ এই বুঝায় যে, বস্তুপিণ্ডটি পৃথিবী থেকে ১,৮০,০০,০০০ কিলোমিটার দূরে আছে। উদাহরণস্বরূপ— পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হলো ৮ “আলোক মিনিট” ২০ আলোক সেকেন্ড। অর্থাৎ দূরত্বটি ১৫,০০,০০০ কিলোমিটার । এক বছর সময়ে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে তার পরিমাণ হলো ৯৪,৬০,০০,০০,০০৩ কিলোমিটার । সংক্ষেপে এই দূরত্বকে বলা হয় ৯.৪৬ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার অথবা ৫.৮৮ ট্রিলিয়ন মাইল। উক্ত দূরত্বকে তোমরা ৯.৪৬ মিলিয়ন মিলিয়ন কিলোমিটার অথবা ৯.৪৬-১০২ কিলোমিটারও বলতে পার। আলোকবর্ষের এককে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ১.২৫ আলোক সেকেন্ড। আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরির (Proxima centuri) দূরত্ব ৪.২৫ আলোকবর্ষ।



 এর অর্থ হলো- যদি আমরা কোনো মহাকাশযানে করে প্রতি সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার বেগে (আলোকের বেগে) উড়ে চলতে পারি তাহলে ঐ নক্ষত্রে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগবে ৪.২৫ বছর (যদিও এই বেগে চলা সম্ভব নয়)। মহাশূন্যে এমন অনেক নক্ষত্র আছে যাদের আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে হাজার হাজার বছর সময় লাগে। সুতরাং ঐ সব দূরতম নক্ষত্রের দূরত্ব প্রকাশ করতে আলোকবর্ষ একক বেশ সুবিধাজনক ।

Leave a Comment