কায়রো শহর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে মিশরের মরুভূমির বুকে ঘিজা (GIZA)-তে তিনটি বিশাল পিরামিডকে প্রহরা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহস্যময় স্ফীংক্স। এক সময় এটি ছিল পিরামিড-প্রাসাদ থেকে পরিত্যক্ত একটি বিশাল প্রস্তর। পরে এটিকে কেটে সিংহের শরীর ও মানুষের মাথার আকৃতিতে রূপান্তরিত করা হয়। শিল্পী, এর দুচোখে অপার রহস্য এবং মুখে দুর্বোধ্য ও বিস্ময়কর অভিব্যক্তি দিয়েছেন। এটি যেন এক দুর্বোধ্য মহানত নিয়ে মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। এই বিশাল মূর্তিটি উচ্চতায় ২০মি. এবং দৈর্ঘ্যে ৭০মি. প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, এটি নির্মিত হয়েছিল প্রায় ৫০০০ বছর আগে। সম্ভবত এটিকে রূপ দেওয়া হয়েছিল মিশর রাজবংশের চতুর্থ রাজা চিফ্রেনের (Chephren) মুখের আদলে ।
তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাও কেন এই বিচিত্র ‘স্ফীংক্স' মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। আসলে, প্রাচীনকালের পুরাণ ইত্যাদিতে ‘স্ফীংক্স'-কে একটি দানবরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। গ্রিকরা এটিকে সিংহের শরীর, দুটি বিশাল পাখা এবং মানবীর মুখ বিশিষ্ট একটি দানবীরূপে কল্পনা করত। মিশরীদের কল্পনায় মূর্তিটি পাখা ছিল না কিন্তু শরীর ছিল সিংহের এবং মুখ ও বক্ষস্থল ছিল মানুষের। তারা বিশ্বাস করত, “স্ফীংক্স' পিরামিডের কবর স্থানের আশপাশ থেকে অশুভ আত্মাদের তাড়িয়ে দিত।
গীর্জার সুবৃহৎ ‘স্ফীংক্স' ছাড়াও মিশরে আরও অনেক স্ফীংক্স মূর্তি আছে। তাদের এক একটির মুখাবয়ব এক একজন রাজার মুখের আদলে নির্মিত। প্রাচীন মিশরে রাজাদের সূর্যদেবতা 'রা' (RA)-এর বংশধর বলে মনে করা হতো। যখন কোনো রাজার মৃত্যু হতো তখন তিনিই নাকি সূর্য দেবতায় পরিণত হয়ে যেতেন। রাজারা বিভিন্ন জন্তুর শক্তিও ধারণ করতেন বলে বিশ্বাস করা হতো। সেই কারণে, মিশরীয়রা তাদের রাজাদের মূর্তি গড়তেন অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক জীবজন্তুর চেহারায়।
মানবী মুখাকৃতির আরও একটি ‘স্ফীংক্স' আছে। এটির রূপ দেওয়া হয়েছিল রাণী হাৎসেপ সুৎ (Hatshepsul)-এর মুখের আদলে। এই রাণী সিংহাসন অধিকার করে স্বয়ং রাজ্য শাসন করতেন। রাণীর চরিত্রের পুরুষ- শক্তি বোঝানোর জন্য স্ফীক্স-এর মুখে দাড়িও খোদিত ছিল ।
কোথায় গেল পৃথিবীর সেই সাতটি আশ্চর্য বস্তু? পৃথিবীর সেই সাতটি আশ্চর্য বস্তুদের কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। তাদের নাম বলতে পারো? সেগুলো কোথায় কোথায় ছিল তা জানো?
আগে নামগুলো শুনে নাও। মিশরের পিরামিড, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান, এফীসাসে আর্তেমিসের মন্দির, এথেন্সে জিয়ুসের মূর্তি, হ্যালিকারনেসাসে সমাধি মন্দির, রোডসে কলোসাসের মূর্তি এবং
আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর।
সেগুলো কবে তৈরি হয়েছিল আর কোথায় কোথায় ছিল, সে বিষয়ে আমরা মোটামুটিভাবে জানি। কেননা একমাত্র মিশরের পিরামিড ছাড়া অন্যগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
পিরামিডগুলো তৈরি হয়েছিল প্রায় ৫০০০ বছর আগে মিশরের সম্রাটদের সমাধি মন্দির হিসেবে। এদের মধ্যে সবচাইতে বড় পিরামিড হলো কায়রো শহরের কাছে গিজে (Gizeh) নামে একটা ছোট জায়গায়। এই পিরামিড মিশরের সেকালের সম্রাট কেঅপস অথনা খুফুর (Cheops অথবা Khufu, 2650C - ২৬৩০০ BC) কবর ছিল। ৭৫০ বর্গফুট জমির ওপর তৈরি এই পিরামিডের উচ্চতা ৪৫১ ফুট। এক লক্ষ দাস শ্রমিক ২০ লক্ষ পাথরের চাঙর বয়ে বয়ে একে গড়ে তুলেছিল ২০ বছর ধরে।
বর্তমান ইরাকে ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ব্যাবিলন শহরে ছিল ঝুলন্ত উদ্যান। সেকালের বিলাস ব্যসনবহুল ব্যাবিলনের এমনই প্রসিদ্ধি ছিল যে, এখনও বিলাস আর অশালীনতাপূর্ণ জায়গাকে ব্যাবিলন বলা হয়। এই ঝুলন্ত উদ্যান ওদের জিগুরাট (ziggurat) বা মন্দিরের ছাদের ওপর ধাপে ধাপে তৈরি করা হয়েছিল । ব্যাবিলনিয়র সম্রাট নেবুকাদনেজ্জার (Nebuchadnezzar, 604-561 BC) তার রাণীকে খুশি করার জন্য এই উদ্যান তৈরি করেছিলেন। ৫১৪ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের আক্রমণে এই উদ্যান ধ্বংস হয়ে যায়।
বর্তমান তুর্কীর এফীসাস (Ephesus) শহরে ছিল চাঁদের দেবী আর্তেমিস অথবা ডায়নার (Artemis অথবা Diana) মন্দির। আর্তেমিস হলো গ্রিক নাম আর ডায়না (মূল লাতিন ভাষায় দিয়ানা) হলো রোমান। মজা দেখেছ, হিন্দুদের কাছে চাঁদ দেবতা হলেও সেকালের গ্রিস আর রোমে চাঁদ দেবী এবং আর্তেমিসের পবিত্রতা ও সতীত্বের দেবী এই আর্তেমিসের মন্দির তৈরি হয়েছিল ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে । থামগুলো ছিল প্রায় ৬০ ফুট উঁচু। ২৬২ খ্রিস্টাব্দে বহিঃশত্রুর আক্রমণে মন্দির ধ্বংস হয়।
গ্রিসদেশের অলিম্পিয়া শহরে ছিল জিয়ুস (Zeus) দেবতার মূর্তি। রোমানদের কাছে জিয়ুসের নাম ছিল জুপিটার (Jupiter)। প্রাচীনকালে গ্রিকদের ইন্দ্রদেব এই জিয়ুস। ফলে মূর্তির উচ্চতাও তেমনিই— ৩০ ফুট । হাতির দাঁত, সোনা-রূপা দিয়ে তৈরি মূর্তি। প্রচুর মণি-মাণিক্য খচিত তো বটেই। মূর্তি গড়েছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত ভাস্কর ফিদিয়াস (Phidias)। তবে খ্রিস্টধর্মের উদ্ভবের পর ধর্মপ্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এই মূর্তি নষ্ট হয় ।
বর্তমান তুর্কীর কারিয়া (caria) রাজ্যের সে সময়ের রাজা মৌসলেসের (Mausolos) জন্য এক বিরাট সমাধি মন্দির তৈরি করা হয় হ্যালিকারনেসাসে (Halicarnassus)। প্রায় ১০০ ফুট উঁচু ছিল এই মন্দির। আর মন্দিরের ওপর ছিল ঘোড়ায় টানা রথে বসে রাজা ও রাণীর মূর্তি। মন্দির তৈরি করেছিলেন রাজা মৌসলসের রাণী আর্তেমিসিয়া (Artemisia) সম্ভবত ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এমনই বিশাল ব্যাপার যে, এর থেকে শব্দ তৈরি হলো লাতিন ভাষায় মৌজলিয়ম (mausoleum) যার মানে বিরাট সমাধি মন্দির। গ্রিসের ম্যাসিডনিয়ার (Maccedonia) দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার এই সমাধি মন্দির ধ্বংস করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে একজন ইংরেজ পর্যটক এই মূর্তিটাই শুধু নিয়ে আসেন এবং তা রাখা হয় লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
বর্তমান তুর্কীর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভূমধ্যসাগরে ডোডেকানীজ দ্বীপপুঞ্জের (Dodecanese Islands) অন্যতম হলো রোডস (Rhodes অথবা Rodhos) (Apollo)। কিংবদন্তী প্রচলিত যে মন্দিরে প্রবেশ পথের মুখে গ্রিক দেবতা হেলিয়সের (Helios রোমানদের এ্যাপলো Apollo ) এক বিশাল মূর্তি ছিল। সে মূর্তি এতই বিশাল যে তাকে বলা হতো কলোসাস (colossus)। শব্দটার মানেই হলো দৈতাকার বিশাল। সম্ভবত ২৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল এই ব্রোঞ্জমূর্তি। খুব বেশি দিন এই মূর্তি রোডস দ্বীপকে রক্ষা করতে পারেনি। তৈরির অল্পদিন পরই ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে যায়।
মিশরে নীল নদের মোহনায় ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ফোয়ারোস (pharos) উপ-দ্বীপ। এখানে ছিল সেই প্রসিদ্ধ বাতিঘর (light house) যার উচ্চতা সাড়ে ৩০০ ফুটের ওপর। চারপাশের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাওয়া হতো। চূড়ায় রাতদিন সব সময় আগুন জ্বলত। এই বাতিঘর বা লাইট হাউস তৈরি করেন সম্রাট টলেমি (Ptolemy) সম্ভবত ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এর টিকে থাকার সন্ধান পাওয়া যায়, তারপর ধ্বংস হয়ে যায়। তবে শুধু সেই দ্বীপ (Pharos) যেখানে এই বাতিঘর ছিল আজ বাতিঘরের প্রতিশব্দ (pharos) হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
Leave a Comment